শ্রী শ্রী সরস্বতী পুজো(Saraswati puja) : ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪(বুধবার), ১লা ফাল্গুন ১৪৩০ বঙ্গাব্দ।
🕉️সরস্বতী পূজা( Saraswati puja ) কী ও কেনো..??? চলুন দেখে নেওয়া যাক:
কোনো সনাতনীকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় যে, দেবী সরস্বতী কে?? বলবে, জ্ঞানের দেবী, বিদ্যার দেবী। আর ? আর কোনো তথ্য তার কাছে নেই। এরপর হয়তো দু’চার জন সনাতনী বলবে যে, সরস্বতী ব্রহ্মার স্ত্রী; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ব্রহ্মার স্ত্রী বলে কিছু নেই বা কিছু হয় না। তাহলে-
🕉️দেবী সরস্বতী কে..??
পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বরের সৃষ্টিকারী রূপের নাম ব্রহ্মা আর ব্রহ্মার নারী শক্তির নাম সরস্বতী; এর মানে হলো সরস্বতীই ব্রহ্মা, আর ব্রহ্মা মানেই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর, অর্থাৎ সরস্বতীই পরমেশ্বর বা ঈশ্বর। অনেকেই সরস্বতীকে ছোটো দেবী হিসেবে মনে করে, প্রকৃতপক্ষে দেব-দেবীদের মধ্যে ছোট বা বড় বলে কিছু নেই, সব দেব-দেবী ই সমান; সুতরাং সরস্বতী, ঈশ্বরেরই একটা রূপের নাম এবং স্ত্রীলিঙ্গে স্বয়ং ঈশ্বরীরূপে সরস্বতীই পরমব্রহ্ম বা ঈশ্বর।
🕉️সরস্বতীর গায়ের রং সাদা কেনো..???
দেবী সরস্বতীর শুভ্র মূর্তি নিষ্কলুষ চরিত্রের প্রতীক; এটা এই শিক্ষা দেয় যে, প্রত্যেক ছেলে মেয়েকে হতে হবে নিষ্কলুষ নির্মল চরিত্রের অধিকারী; যে ছেলে-মেয়ে বাল্যকাল থেকে নিজেকে নিষ্কলুষ রাখার চেষ্টা করবে, সে যে সারা জীবন তার সকল কর্ম ও চিন্তায় নিজেকে নিষ্কলুষ রাখতে পারবে, তাতে তো আর কোনো সন্দেহ নেই।
🕉️সরস্বতীর সাথে রাজহাঁস থাকে কেনো..??
রাজ হাসেঁর মধ্যে এমন ক্ষমতা আছে যে, এক পাত্রে থাকা জল মিশ্রিত দুধের থেকে সে শুধুমাত্র দুধ শুষে নিতে পারে। সরস্বতী যেহেতু বিদ্যা ও জ্ঞান সংশ্লিষ্ট দেবী, সেই প্রেক্ষাপটে এটা বলা যেতে পারে যে, রাজহাসেঁর এই তথ্য শিক্ষার্থীদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, সমাজে ভালো মন্দ সবকিছুই থাকবে, তার মধ্যে থেকে তোমাদেরকে শুধু ভালোটুকু শুষে নিতে হবে। অধিকাংশ সনাতনী ছেলে-মেয়েরা যে মেধাবী এবং চরিত্রবান বা চরিত্রবতী, সরস্বতী পূজা এবং তার রাজহাঁস জনিত এই শিক্ষাই তার কারণ।
🕉️সরস্বতীর হাতে বীণা থাকে কেনো..??
এর কারণ হচ্ছে-সনাতন ধর্ম হলো নাচ, গান ও জ্ঞান সমৃদ্ধ শিল্পকলার ধর্ম; যা সামাজিক বাস্তবতাকে সম্পূর্ণভাবে সাপোর্ট করে। কারণ, প্রত্যেক ছেলে মেয়েই কোনো না কোনো প্রতিভা নিয়ে জন্মগ্রহন করে; প্রকৃতির ধর্ম হিসেবে সনাতন ধর্ম এই সামাজিক বাস্তবতাকে স্বীকার করে, এই কারণেই দেবী সরস্বতীর হাতের বীণা হচ্ছে সেই শিল্পকলার প্রতীক। আর এটা সুধীজন স্বীকৃত যে, যারা- নাচ, গান, কবিতা লেখা বা নাট্যচর্চার মতো শিল্পকলার সাথে জড়িত, তাদের সাধারণত কখনো মিথ্যা, চুরি, ডাকাতি, খুন ও ধর্ষণের মতো চিন্তাধারা কম আসে। সাধারণ ভাবে বেশির ভাগ সনাতনীরা যে সৎ প্রকৃতির এবং প্রত্যেক সনাতনী ছেলে মেয়েই যে শিল্পকলার কিছু না কিছু জানে, এটাই তার অন্যতম কারণ।
🕉️সরস্বতীর হাতে পুস্তক থাকে কেনো..??
পুস্তক হলো জ্ঞানের ভাণ্ডার বা জ্ঞানের বাস হলো পুস্তকে। যেহেতু সরস্বতী হলো জ্ঞানের দেবী, তাই তার হাতে থাকে পুস্তক বা পূজায় পাঠ্যপুস্তক দিতে হয়। পৃথিবীতে হিন্দুরাই একমাত্র জাতি যারা জ্ঞানার্জনের জন্য পূজা প্রার্থনা করে। একারণেই সনাতনীরা একটি জ্ঞান পিপাসু এবং জ্ঞান সমৃদ্ধ জাতি। এখনও যেকোনো স্কুলে যে কয়জন সনাতনী ছাত্র-ছাত্রী পাওয়া যাবে, দেখা যাবে তাদের মধ্যে প্রায় ৯০% ই কোনও না কোনও দিক থেকে ভালো করে থাকে।
🕉️সরস্বতীর দুই হাত না চার হাত…??
বর্তমানে দেবী সরস্বতীকে দুই হাত বিশিষ্ট দেখা গেলেও দেবী সরস্বতীর মূল প্রতিমা আসলে চার হাত বিশিষ্ট, এরকম ছবি আপনারা হয়তো অনেক জায়গায় দেখলেও দেখে থাকতে পারেন, সরস্বতীর মূল থিমের সাথে এই চার হাতই মানানসই; কারণ হলো- পড়াশুনার পাশাপাশি কেউ যদি নাচ গান বা অন্য যে কোনো শিল্পকলায় এক্সপার্ট হতে চায়, তাকে দুই হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়ে কাজ করলে চলবে না, তাকে চার হাতের শক্তি ও ব্যস্ততা নিয়েই কাজ করতে হবে।
🕉️সরস্বতীর আসন, রাজহাঁস নাকি পদ্মফুল..??
অনেক কাঠামোতে দেখা যায়, সরস্বতী দেবী হাঁসের উপর বসে আছে আবার কোনো কাঠামোয় দেখা যায় পদ্মফুলের উপর; পদ্মফুলের উপর সরস্বতীর আসন ই সঠিক আসন। এর কারণ- পূর্ণ প্রস্ফুটিত পদ্মফুল হলো সফল ও সমৃদ্ধ জীবনের প্রতীক; এই কারণেই লেখা হয়েছে- “ফুলের মতো গড়বো মোরা মোদের এই জীবন” এই ধরণের কবিতা। এককথায় ফুলের বিকাশের সাথে মানুষের জীবনের বিকাশকে তুলনা করা হয়েছে। পূর্ণ বিকশিত একটি পদ্মফুলের উপর সরস্বতীর বসে থাকার মানে হলো- সরস্বতীর আদর্শকে লালন করে নিজের জীবনকে বিকশিত করতে পারলে সেই জীবনও ফুলের মতোই পবিত্র, সুন্দর, বিকশিত ও সমৃদ্ধ হবে।
🕉️সরস্বতীকে কেনো মাতৃ প্রতিমা হিসেবে পূজো করা হয়…??
স্বয়ং ঈশ্বরের অংশ হলেও সরস্বতী নারী প্রতিমা অর্থাৎ মাতৃ প্রতিমা,,এর কারণ হলো- পিতার চেয়ে মায়ের কাছে কোনো কথা বলা সহজ বা কোনো কিছু চাওয়া সহজ। সরস্বতীর পূজারীরা যেহেতু সাধারণভাবে শিশু বা বালক-বালিকা অর্থাৎ শিক্ষার্থী, তাই তারা যাতে সহজে নিজের মনের কথা, নিজের মনের আকুতি দেবী মায়ের কাছে জানাতে পারে, এজন্যই সরস্বতীকে কল্পনা করা হয়েছে মাতৃরূপে।
প্রণাম মন্ত্রঃ
নমো সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমল-লোচনে।
বিশ্বরূপে বিশালাক্ষ্মী বিদ্যাং দেহি নমোহস্তুতে।।
জয় জয় দেবী চরাচরসারে,কুচযুগশোভিত
মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।।
🕉️পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র
ঃ ওঁ জয় জয় দেবী চরাচর সারে,কুচযুগ-শোভিত মুক্তাহারে।
বীণারঞ্জিত পুস্তক হস্তে, ভগবতী ভারতী দেবী নমোহস্তুতে।।
নমঃ ভদ্রকাল্যৈ নমো নিত্যং সরস্বত্যৈ নমো নমঃ।
বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত-বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ।।
এষ সচন্দন পুষ্প বিল্ব-পত্রাঞ্জলি সরস্বতৈ নমঃ।।
শেষে একটা ছোট্ট তথ্য– বৌদ্ধ মতবাদ যেহেতু সনাতন ধর্ম থেকে উদ্ভূত, সেই কারণেই হোক বা হিন্দুদের জ্ঞান অর্জনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখেই হোক, বৌদ্ধরাও সরস্বতী পূজা করে।